আফগানিস্তানের ফারিয়াব প্রদেশের রাজধানী মায়মানা। শহরটির নতুন মেয়র ২৫ বছর বয়সী দামুল্লাহ মহিবুল্লাহ মোয়াফফাক। মায়মানার রাস্তার পাশের নর্দমা পরিষ্কার করছিলেন পৌর কর্মীরা। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় পৌর কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে দেখা যায় নতুন মেয়র মহিবুল্লাহকে। প্রায় এক লাখ বাসিন্দার শহরের অনেক মানুষ মহিবুল্লাহর কাছে অভিযোগ নিয়ে আসছিলেন। কেউ-বা দিচ্ছিলেন পরামর্শ। তিনি সব অভিযোগ ও পরামর্শ টুকে নিচ্ছিলেন। আর প্রয়োজন অনুযায়ী নিচ্ছিলেন পদক্ষেপ।
মহিবুল্লাহর সহকারী হিসেবে কাজ করছেন সৈয়দ আহমাদ শাহ গেয়াসি। মহিবুল্লাহ সম্পর্কে তাঁর এই সহকারী বলেন, ‘নতুন মেয়র বয়সে তরুণ। তিনি সুশিক্ষিত। সবচেয়ে বড় কথা হলো, তিনি এই শহরেরই সন্তান। তিনি ভালো করেই জানেন যে এখানকার মানুষের সঙ্গে কীভাবে চলতে হবে।’ধনী বণিক পরিবারের সদস্য মহিবুল্লাহ। তিনি মায়মানাতেই বেড়ে উঠেছেন। স্কুলে ভালো ছাত্র হিসেবে তাঁর নাম ছিল। এ ছাড়া বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলায়ও তিনি বেশ পারদর্শী ছিলেন।
শৈশব-কৈশোরে মহিবুল্লাহর নানান অর্জন আছে। এসব অর্জনের নানা স্মারক ও সনদ তাঁর কার্যালয়ে শোভা পেতে দেখা যায়। এর মধ্যে হাইস্কুলে পড়ালেখার সময় মার্শাল আর্ট প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে পাওয়া কৃতিত্বের সনদও রয়েছে। মহিবুল্লাহ ১৯ বছর বয়সে তালেবানে যোগ দেন। পরে তাঁকে ফারিয়াব প্রদেশের একটি ছোট তালেবান ইউনিটের প্রধান করা হয় অনেকে মহিবুল্লাহকে তালেবানের অন্যতম দক্ষ স্নাইপার যোদ্ধা বলে বর্ণনা করে থাকেন।
এএফপির প্রতিনিধির সঙ্গে মায়মানার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একটি বাড়ির সামনে গিয়ে থেমে যান মেয়র মহিবুল্লাহ। বাড়িটিতে এখনো যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন রয়েছে। এই বাড়িতে থেকেই একসময় তিনি তাঁর তালেবান ইউনিট চালাতেন। এখানেই মহিবুল্লাহ স্নাইপার নিয়ে লুকিয়ে থাকতেন। স্নাইপারের নিশানার নাগালে মার্কিন সেনাদের পাওয়ার জন্য তিনি অপেক্ষা করতেন। সাইফুদ্দিন নামের স্থানীয় এক কৃষক বলেন, এই বাড়ি থেকেই তিনি (মহিবুল্লাহ) গুলি করে এক মার্কিন সেনাকে হত্যা করেন। পরে একটি যুদ্ধবিমান এসে বাড়িটি লক্ষ্যবস্তু করে তাঁর ওপর বোমা হামলা করে।
মাস কয়েক আগেও মহিবুল্লাহ ছিলেন তালেবানের এক শীর্ষস্থানীয় স্নাইপার। আফগানিস্তান দখলের লড়াইয়ে স্নাইপার হাতে লুকানোর জায়গা থেকে শত্রুপক্ষকে নিশানা করে নির্ভুল গুলি ছুড়তেন মহিবুল্লাহ। দক্ষ স্নাইপার হিসেবে তিনি তালেবান বাহিনীতে পরিচিতি পান। যুদ্ধদিনে মহিবুল্লাহর হাতে বা কাঁধে থাকত স্নাইপার। প্রাণঘাতী এই অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে বিচরণ করতে তিনি। আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখলে তালেবানের ‘শত্রু’নিধনই ছিল তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। বিদেশিদের হটিয়ে, পশ্চিমা-সমর্থিত সরকার উৎখাত করে আফগানিস্তানের ক্ষমতা তালেবানের দখলে যাওয়ার পরের প্রেক্ষাপটে মহিবুল্লাহর দায়িত্ব বদলে যায়। স্নাইপার চালানোর বদলে তিনি এখন একটি শহর চালান। তবে মহিবুল্লাহকে এখনো প্রচুর ঘুরতে হয়। পায়ে হেঁটে চষে বেড়াতে হয় শহরের অলিগলি। মেয়র হওয়ার পর থেকে মহিবুল্লাহকে নগরবাসীর নানা সমস্যার কথা শুনতে হচ্ছে। অভাব-অভিযোগ-সমস্যার কথা শুনে তা সমাধানের চেষ্টা করছেন তিনি। এখন মহিবুল্লাহর দৈনন্দিন কাজের তালিকায় রয়েছে বন্ধ হয়ে থাকা নর্দমা সচল করা, সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন, স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যকার বিবাদ-বিরোধ নিরসনের মতো অনেক বিষয়।
বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদনে বলা হয়, দুর্ধর্ষ স্নাইপার যোদ্ধা থেকে মহিবুল্লাহর নগর ও জনবান্ধব কর্মব্যস্ত মেয়র হওয়ার প্রচেষ্টার বিষয়টি তালেবানের রূপান্তর প্রক্রিয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।মহিবুল্লাহকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এএফপি। তিনি এএফপিকে খোলামেলাভাবে বলেন, ‘আমি যখন যুদ্ধে ছিলাম, তখন আমার লক্ষ্য ছিল খুবই স্পষ্ট—বিদেশি দখলদারি, বৈষম্য ও অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটানো।’ মহিবুল্লাহ বলেন, ‘এখন আমার লক্ষ্য স্পষ্ট—দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করা ও দেশকে সমৃদ্ধ করে গড়ে তোলা।’